“তব প্রেম দেখে আমি মনে হলেম হতজ্ঞান,
তুমি প্রাণ দিয়ে নাথ প্রাণ কিনেছো।
তাইতে প্রাণের প্রাণ তুমি,..”
কলকাতা তথা বাংলায় বড়দিন পালনের ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরে পুরনো ! ব্রিটিশ ছাড়াও ফরাসী-ডাচ-ইস্পাহানি-পর্তুগীজ-ডেনিস-সুইডিশ প্রভৃতি বিভিন্ন জাতের ইউরোপীয় মার্চেন্ট , মেরিনার , প্লান্টার , মেসিনার, সেটেলাররা বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে বানিজ্য কুঠি বানিয়েছিল ! আর সেই সঙ্গে সঙ্গে গড়ে তুলেছিল পাঞ্চ হাউস (পানশালা) আর গীর্জা ! গীর্জা মানে চন্দননগরের গীর্জা বা কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের মত প্রকান্ড স্থাপত্য নয় , সাধারণ চালার ঘরে ক্যানভাসে আঁকা প্রভু যীশুর ছবি আর দেশ থেকে আনা হিব্রু বাইবেলের একটা মডেল রেখে তৈরী অস্থায়ী উপাসনালয় ! রবিবারদিন গীর্জায় হাজির হওয়া ছিল কুঠিয়ালদের সামাজিক মিলনোৎসব !আর বড়দিন এলেই এইসব অস্থায়ী গীর্জা গুলোকে সাজানোর প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যেত !কোন কুঠীর গীর্জায় বড়দিনে কত জাঁকজমক হল সেই রিপোর্ট এমনকি লিখে পাঠানো হত স্বদেশে , হেডকোয়ার্টারে !
উৎসবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল খাওয়া-দাওয়া । বড় ভোজে রোস্ট মাংস, বিশেষ কেক, ওয়াইন এবং স্থানীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি কিছু খাবার পরিবেশন করা হতো। ইউরোপীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে এ উৎসব ধীরে ধীরে স্থানীয়দের মধ্যেও কৌতূহল তৈরি করেছিল।
পাঞ্চ হাউজের ইতিহাস ও বড়দিন
“কোথায় নেটিভ লেডি শুন শুন সবে
পশুর স্বভাবে আর কতকাল রবে ?
ধন্য রে বোতলবাসী ধন্য লাল জল
ধন্য ধন্য বিলাতের সভ্যতার ফল
দিশিকৃষ্ণ মানিনেক ঋষিকৃষ্ণ জয়
মেরিদাতা মেরিসুত বেরি গুড বয় !”
(ঈশ্বর গুপ্ত, ‘ইংরাজী নববর্ষ’)
জব চার্নকের আমলে যখন ব্রিটিশরা সুতানুটি, গোবিন্দপুর, এবং কলকাতা নিয়ে নতুন শহরের ভিত্তি স্থাপন করেন তখন কাশিমবাজার, হুগলী , কলকাতা এইসব জায়গায় আরেকটি মজার দিক ছিল সাহেবদের পানশালাগুলি, যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিল "পাঞ্চ হাউজ" নামে। পাঞ্চ (punch) পানীয় সেই সময় এদেশে বানিজ্য করতে আসা ইউরোপীয়দের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এই পানীয়র মূল উপাদান ছিল পাঁচটি জিনিস: চিনি, মশলা (যেমন দারচিনি), লেবুর রস, মদ এবং পানি। এটি আসলে ভারতীয় "পাঁচ" (সংখ্যা পাঁচ) শব্দ থেকেই এসেছে।
বড়দিনের উৎসবে এই পাঞ্চ ছিল অপরিহার্য। সাহেবদের বড়দিনের পার্টিতে পাঞ্চ হাউজগুলো ভরে যেত। সাহেব-মেমরা শুধু ধর্মীয় আচার পালনেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না; তাঁরা জমিয়ে নাচগান, আলাপ-আলোচনা করতেন। পাঞ্চ পানীয় নিয়ে মেমসাহেবদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো—কেউ কেউ নিজের বিশেষ রেসিপি নিয়ে গর্ব করতেন।
পাঞ্চ হাউজ ছিল শুধু পানশালা নয়, সামাজিক মেলামেশার কেন্দ্রও। সাহেবরা এখানে বসে ব্যবসার পরিকল্পনা করতেন, গসিপ করতেন, আর অবশ্যই বড়দিনের প্রস্তুতি নিতেন।
স্থানীয়দের প্রভাব
“যীশু পরম দয়ালু,
তাহার কৃপায় দাড়ি গজায়
শীতকালে খাই শাঁকালু”
পাঞ্চ হাউজ ও বড়দিনের উৎসব দেখে স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে ইউরোপীয় জীবনধারার প্রতি এক ধরনের কৌতূহল তৈরি হয়। ধর্মীয় বেড়াজাল ও সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে যদিও তাঁরা সরাসরি এসব উৎসবে যোগ দিতেন না, কিন্তু এর প্রভাব ধীরে ধীরে বাঙালির খাবার ও উৎসবের রীতিতে ঢুকে পড়ে।
প্রাচীন ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির নথি থেকে জানা যায় জব চার্নকের আমলে পাঞ্চ হাউজ শুধু ইউরোপীয়দের আনন্দের জায়গা ছিল না, বরং এটি কলকাতা তথা বাংলার ভবিষ্যৎ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের একটি ভিত্তি তৈরি করেছিল ! আবার বাংলার লৌকিক সাহিত্যে এই বড়দিন উৎসবকে কেন্দ্র করে সাহেব মেমসাহেবদের উদ্দীপনার বিষয়ে অনেক কৌতুক গান বা ছড়ার উদাহরণও আছে !
বাংলা খ্রিস্টান কীর্তন বা যীশু ভজনের ইতিহাস
“খ্রিস্টের জন্মের দিনে,
সবাই মিলে খুশিতে গানে।
পাপীদের তরে প্রভু এলেন,
মঙ্গলময় করে দেন সব খানে।”
বাংলায় বড়দিনের ইতিহাস বলতে গিয়ে আরেকটি বিষয় না বললেই নয় , সেটা হল বাংলা বাংলা খ্রিস্টান কীর্তন বা যীশু ভজন ! বাংলায় খ্রিস্টধর্মের প্রচার শুরু হয় পর্তুগিজ মিশনারিদের হাত ধরে। ১৬শ শতকে তাঁরা গঙ্গার পাড় ধরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। যীশু ভজন বা বাংলা খ্রিস্টীয় গান গাওয়ার প্রথার সূত্রপাত হয় এই সময় থেকেই।
বাংলার খ্রিস্টানরা ভজনের সুরে স্থানীয় কীর্তনের ছন্দ ও ঢংকে অন্তর্ভুক্ত করেন। ভজনগুলো সাধারণ বাংলা ভাষায় রচিত হতো, যাতে স্থানীয়রা সহজে তা বুঝতে পারে। ক্রিসমাস এবং ইস্টার উপলক্ষে যীশু ভজন গাওয়া হতো গির্জায়, যা ক্রমে বাংলার খ্রিস্টান সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে ওঠে।
যীশু কীর্তনের বিষয়বস্তুগুলি হল মূলত – যীশুর জন্ম কাহিনী ও তার মাহাত্ম্য , যীশুর ক্রুশবিদ্ধ
হওয়ার কাহিনী ,যীশুর পুনরুত্থানের মিথ ইত্যাদি
যীশু ভজনের ভাষা ও সুর
বাংলা যীশু ভজনের ভাষা হত সাধারণত সরল এবং সহজবোধ্য। এতে বাংলার লোকসংগীত, কীর্তন, এবং বাইজী সঙ্গীতের ধারা মিশে গেছে ! ভজনের সুর সাধারণত ধীর এবং আবেগময়, যা প্রার্থনার আবহ তৈরি করে।
“পাপী আমি, তবু পূর্ণ তোমার প্রেমে,
তোমার রক্তে ধুয়ে তুমি আমাকে মুক্ত করেছ
ওগো শিশু বেথেলহেমের”
Kommentare